সোনারগাঁও দর্পণ :
‘জানাজা’ মুসলমানের মৃত্যু পরবর্তী এবং দাফন (কবর দেয়া) করার পূর্বে জীবনের শেষ নামাজ। একজন মানুষ মারা গেলে স্বভাবতই তাকে শেষ বারের মতো দেখতে মৃতের বাড়িতে মৃত ব্যক্তিকে ঘিরে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব,শুভাকাঙ্খী এবং সমাজের লোকজনের সমাগম হয়। শেষবারের মতো দেখতে যান তারা।
একজন মানুষের মৃত্যুর পর তাকে সমাহিত করতে বিভিন্ন ধর্মের রয়েছে বিভিন্ন রীতি-নীতি। মুসলমানদেরও রয়েছে ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক নিয়ম। জানাজা’র নামাজ রীতিনীতির অন্যতম অংশ।
জানাজার নামাজকে ইসলাম ধর্মে ফরযে কেফায়া হিসেবে গণ্য করা হয়। ফরজে কেফায়া’র অর্থ সমাজের জন্য আবশ্যকীয় দায়িত্ব। জানাজার নামাজে অংশ নেয়ার গুরুত্বকে কোন কোন মুফতি বা মহাদ্দিসরা এমনভাবে উল্লেখ করেছেন যে, কোন মুসলমানের মৃত্যু সংবাদ পেলে তার জানাজা’র নামাজে সে ব্যক্তির সমাজ থেকে একজনও যদি অংশ নেন তাহলে সমাজের সকলের জন্য তা পালন হয়ে যায়। অর্থাৎ একজন মুসলমানের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া ব্যক্তি বা তার সমাজের থেকে একজন হলেও জানাজা নামাজ অবশ্যই পরতে হয় (স্থান,কাল এবং পরিবেশ অনুকুলে থাকলে)।
জানাজা’র নামাজের কিছু আগে মাইয়াত’কে (মৃতের মরদেহ) সামনে নিয়ে তা থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য ইমাম মৃত্যু সম্পর্কিত আয়াত বলে উপস্থিত মৃত ব্যক্তিকে সাক্ষি হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং তার জীবনের গুণাহ মাফের পাশাপাশি কবরের আযাব থেকে মুক্তি ও সওয়ালের জাবব যেন সহজ হয় তার জন্য আল্লাহপাকের দরবারে বিশেষ দোয়া করেন। আর মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে মৃতের সাথে কোনরকম লেনদেন বা দেনা-পাওনা মাফ ও পরিশোধ বিষয়ে সকলকে অবগত করেন তার পরিবারের কেউ।
কিন্তু বর্তমান সময় দেখা যায়, ‘জানাজা নামাজ’কে পরিণত করা হয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পরিচিতি ও বক্তৃতা প্রদানের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে। যার ফলে অনেক মুসলমান বা জানাজা’র নামাজে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের পরতে হচ্ছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। এমনও দেখা গেছে, নেতাদের দীর্ঘ বক্তৃতার কারণে কোন কোন মুসলমান জানাজার নামাজে অংশ না নিয়েই স্থান ত্যাগ করেন বিরক্ত হয়ে বা সময়ের অভাবে। অতি সম্প্রতি এমন একাধিক ঘটনাও দেখেছেন এ প্রতিবেদক। এমনকি যারা জানাজায় অংশ নেয়ার জন্য গিয়েছেন তারা নেতা-কর্মীদের ধারাবাহিক বক্তৃতার কারণে জানাজায়তো অংশ নেননি, তারওপর ভবিষ্যতে আর কোন নেতার জানাজায় অংশ নিবেন না বলেও পণ করেছেন।
পবিত্র আল-কোরআন’র আল-আনকাবুত সুরার ৫৭ নং আয়াতে আল্লাহ নিজে বলেছেন ‘কুল্লু নাফসিন জায়েকাতুল মাউত’ ছুম্মা ইলাইনা তুরজাউন” অর্থাৎ প্রতিটি জীবকে বা সৃষ্টিকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে, তারপর আমার কাছেই তোমাদের ফিরিয়ে আনা হবে।”
এখন কথা হচ্ছে, বিষয়টি আমরা ইসলাম ধর্মের লোকজন জানি এবং মানি। তবে মুসলমান ছাড়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের সকলে তা জানলেও অনেকেই বিশ্বাস করেনা। আমাদের পরবর্তী জীবন অর্থাৎ কেয়ামতের পর আমাদের প্রত্যেকের সকল কাজের হিসাব-নিকাশ নেয়া হবে হাঁশরের দিন।
যারা জানাজা’র নামাজে রাজনৈতিক পরিচিতি বা বক্তৃতা দেন সে ক্ষেত্রে ইসলাম কি বলে ? এমন প্রশ্ন ছিল দু’জন মাওলানা ও ইমামের কাছে।
সোনারগাঁও সরকারি কলেজ জামে মসজিদের ইমাম মওলানা আব্দুর রহমান বলেন - একজন মানুষের মৃত্যু হওয়ার সাথে সাথে দুনিয়ার বাসিন্দা হিসেবে তার নাম বন্ধ হয়ে যায়। নাম লেখা হয় পরকালের খাতায়। একজনের মৃত্যুর পর কোন রকম কালক্ষেপন না করে যতদ্রুত সম্ভব তাকে দাফন করার নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। বর্তমানে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বক্তব্যের কারণে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে জানাজা নামাজ পরতে দেখা যায়। যেটি অবশ্যই ইসলাম শরীআহ এর পরিপন্থি বলে জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, মাইয়াতকে সামনে রেখে কিছু কথা বলা যায় তখন, যখন মাইয়াত সামনে আছে। জানাজা’র যে সময় দেয়া হয়েছে সে সময় হতে আরো কিছু সময় আছে। যারা জানাজা’র অপেক্ষায় আছেন তারা যেন ধৈর্য হারা না হোন সে কারণে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত মাইয়াতকে বাস্তবিক প্রমাণ হিসেবে রেখে কোরআন ও হাদিস থেকে শিক্ষনীয় কিছু বলা যেতে পারে।
দমদমা মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা মুফতি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, মাইয়াতকে সামনে রেখে বাড়তি কোন কথা বলা সম্পূর্ণভাবে ইসলামী শরিয়াহ’র পরিপন্থি। কারণ একজন ব্যক্তির মৃত্যু হলে তিনি আর ইহজগতের থাকেন না। তিনি হয়ে যান পরকালের মেহমান। মহানবী (সাঃ) এর নির্দেশ হচ্ছে যখন কেউ মৃত্যুবরণ করবে যতদ্রুত সম্ভব তাকে দাফন কর। তাছাড়া, জানাজার নামাজে উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন মানুষের নানা বিষয়ে কথা বলা একতো শরিয়াহ’র বাইরে অপরদিকে, অমানবিকও। কারণ এতে অনেকের কষ্ট হয়। এছাড়া একজন মানুষের উপর অপর মানুষের ৫টি হকের মধ্যে জানাজা’র নামাজে অংশ নেয়া অন্যতম হক। একজনের জানাজা’র নামাজে অনেক শুভাকাঙ্খি, অনেক মুহিব্বিন, অনেক আত্মীয়-স্বজন এই দায়িত্বপালন করতে আসেন। এরমধ্যে অনেকে অসুস্থ থাকেন। অনেকের অনেক ধরণের কাজ বা বিভিন্ন ধরনের সমস্যাও থাকে। তারপরও আসেন দায়িত্ববোধ, কর্তব্য বা ভালবাসা থেকে। তো সময়ক্ষেপনের কারণে এবং দীর্ঘ বক্তব্যের কারণে অনেকের সমস্যা হয় বা কষ্টও হয়। সুতরাং জানাজার নামাজ কোন কালক্ষেপন না করে দ্রæততম সময়ের মধ্যে দাফন-কাফন করাই শরিয়াহ’র নির্দেশ।
Post a Comment